গর্ভাবস্থায় একজন মা কোন খাবারগুলো খেলে তার গর্ভের সন্তান মেধাবী ও বুদ্ধিমান হবে ? একটি মেয়ের সারা জীবনের স্বপ্নই থাকে যে তার সুন্দর একটি সংসার হবে এবং তিনি ভবিষ্যতে মা হবেন। তারপর একদিন যখন তার এই স্বপ্নটা পূরণ হয় অর্থাৎ তিনি যখন সত্যিই গর্ভবতী হন। তখন তার পাশাপাশি তার পরিবারের অন্যান্য সকল সদস্যদেরও আনন্দের সীমা থাকে না। সবাই তখন গর্ভবতী মা ও ভবিষ্যৎ বাচ্চার প্রতি বাড়তি যত্ন নেয়ার ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
পাশাপাশি সবার মনের মধ্যে এক ধরনের টেনশন কাজ করে যে, গর্ভের আগত সন্তানটি কেমন হবে? মেধাবী হবে না কি অন্যকিছু। তবে গর্ভের সন্তান মেধাবী ও বুদ্ধিমান হোক এটাই সবসময় প্রত্যাশা করেন সবাই। তাদের বাচ্চাটি যেন অন্যদের বাচ্চার থেকে অনেক বুদ্ধিমান ও মেধা সম্পন্ন হয়ে জন্ম গ্রহণ করুক।
তাই গর্ভাবস্থা থেকেই একজন মাকে সঠিক ডায়েট প্ল্যান বা কিছু পুষ্টিকর খাবার গুরুত্ব সহকারে খেতে হবে। তাহলেই আশা করা যায় যে, আপনার গর্ভের সন্তান মেধাবী ও বুদ্ধিমান হবে। সঠিক ডায়েট প্ল্যান করে যদি একজন গর্ভবতী মা খেতে ও চলতে পারেন তাহলে সেই খাবারগুলো গর্ভাবস্থায়ই বিভিন্নভাবে সাহায্য করবে বাচ্চার ব্রেইন ডেভেলপ করার জন্য।
চিকিৎসকদের মতে গর্ভাবস্থায়ই একটি শিশুর ২৫ ভাগ ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট হয়ে যায়। আর একজন গর্ভবতী মাকে গর্ভকালীন সময়ে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়। সেটা হল প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ট্রাইমেস্টার। প্রথম ট্রাইমেস্টার হল গর্ভধারণের প্রথম তিন মাস। দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার হল চতুর্থ মাস হতে সপ্তম মাস পর্যন্ত। এই দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারটি হল একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পিরিয়ড।
এই সময় একজন প্রসূতি মায়ের ক্যালরির চাহিদায় অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়। অনেকে আবার মনে করেন গর্ভাবস্থায় প্রসূতি মাকে বেশি করে খাবার খেতে হবে। বেশি খেতে হবে ঠিক আছে কিন্তু কোন খাবারগুলো বেশি খেতে হবে সেটা আগে জানাটা বেশি জরুরী। আবার বেশি খেতে খেতে মায়ের ওজন বাড়িয়ে ফেলাও যাবে না।
এমন ভাবে খাবার গ্রহণ করতে হবে যাতে করে গর্ভাবস্থায় মা সকল পুষ্টি গ্রহণ করবেন ঠিকই কিন্তু তার ওজন বাড়বে না। অর্থাৎ খাবারের সাথে সাথে তার ওজনটাও স্বাভাবিক থাকতে হবে। এই সময় আয়রন কনজাম্পশন, ফলিক এসিড, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি ও বি কমপ্লেক্স সহ যে সমস্ত খাবারগুলোর মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি বিদ্যমান রয়েছে এই খাবারগুলোকে যদি প্রতিদিনের খাদ্যতালিকার সাথে সমন্বয় করে খাওয়া যায় তাহলে বাচ্চার ব্রেইন ডেভলপমেন্ট ও বুদ্ধি নিয়ে অভিভাবকদের তেমন কোনো চিন্তার প্রয়োজন পড়ে না।
আরও পড়ুনঃ
১। একজন গর্ভবতী মায়ের আদর্শ খাবার তালিকা।
২। কি খেলে গায়ের রং কালো থেকে ফর্সা হয়।
৩। সন্তান নেয়ার পূর্ব প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিত।
আমরা সব সময় বাচ্চার ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট টাকেই নিয়ে বেশী চিন্তা করে থাকি। তাই এই গর্ভাবস্থায় যদি সেই সমস্ত খাবারগুলোর চাহিদা পূরণ করতে পারেন তাহলে গর্ভ পরবর্তী অবস্থায় এ নিয়ে দুশ্চিন্তা কম করলেও হবে। গর্ভাবস্থায় মা চেষ্টা করবেন যে, সকাল হতে রাত পর্যন্ত তার খাবারগুলোকে একটু সুন্দর করে আর গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করতে।
সন্তান মেধাবী ও বুদ্ধিমান হতে চাইলে গর্ভের সময় মায়ের প্রোটিন গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী। যেমন মাছ, ডিম, মুরগীর মাংস, পাঁচমিশালি ডাল, বিনস ইত্যাদি। অর্থাৎ খাবারের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রোটিনকে রাখতে হবে। সকালের নাস্তায় একটি ডিম হতে পারে প্রোটিনের জন্য উৎকৃষ্ট উৎস। কারন ডিমে যে পরিমাণ ভিটামিন বি কমপ্লেক্স আছে এবং স্পেশালি কোলিন আছে যা ব্রেইনের নিউরো ট্রান্সমিটার হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশে এবং স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
তাই খাবার থেকে এটাকে কখনোই বাদ দেয়া যাবে না। পুরো প্রেগনেন্সির সময়টা জুড়েই একজন গর্ভবতী মা যে কাজটি করতে পারেন সেটা হলো মায়ের নিজের চাহিদার জন্য একটি ডিম ও গর্ভের বাচ্চার প্রোটিনের চাহিদা পূরণের জন্য আরেকটি ডিম খেতে পারেন। অর্থাৎ দুই টি ডিম তাকে গর্ভাবস্থায় খেতে হবে। যাদের সরাসির ডিম খেতে খুব কষ্ট হয় বা খাবারে রুচি হয় না অর্থাৎ কোন ভাবেই ডিম খেতে না পারলে ডিমের তৈরি বিভিন্ন রেসিপি বানিয়ে খেতে পারেন।
একজন গর্ভবতী মাকে অ্যান্টি অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার নিশ্চিত করতে হবে তার গর্ভের সন্তান মেধাবী ও বুদ্ধিমান হওয়ার জন্য। যেমন রঙিন শাক সবজি বিশেষ করে পালংশাক, বাঁধাকপি, ব্রকলি, গাজর, টমেটো, বাদাম, কালোজাম ইত্যাদি প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় অবশ্যই রাখতে হবে। এগুলোতে থাকা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও ভিটামিন ই মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে শিশুর স্মৃতিশক্তি মজবুত করে।
বিভিন্ন ধরনের বাদাম খাওয়া যেতে পারে। একজন গর্ভবতী মা সপ্তাহে তিন চার দিন বিভিন্ন ধরনের বাদাম খাবেন। কারণ বাদাম হল ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড এর উৎস। বিভিন্ন ধরনের মিনারেলস এবং ভিটামিনের সমন্বয় রয়েছে বাদামের মধ্যে। এক্ষেত্রে দেশি চিনা বাদাম, কাজু বাদাম, কাঠ বাদাম ইত্যাদি সব ধরনের বাদাম একত্রে মিক্স করেও তিনি খেতে পারেন।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত খাবারের উৎসগুলো হল কুমড়ার বিচি বা সূর্যমুখীর বিচি, সামুদ্রিক মাছ যেমন স্যালমন, টুনা, ম্যাকেরেল ও কড লিভার তেল। এগুলতে প্রচুর পরিমানে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে। এছাড়া সামুদ্রিক মাছে DHA (Docosahexaenoic Acid) এবং EPA (Eicosapentaenoic Acid) থাকে। যা পরবর্তী সময়ে শিশুর মানুসিক বিকাশে, শরীরের সুস্থতায়, শরীরকে পরিপূর্ণ এনার্জির জোগান দেয়া থেকে শুরু করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখা ও মস্তিষ্কের কোষগুলিকে সঠিক কাঠামো দিতে পারে ফলে বাচ্চার বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে।
বিভিন্ন ধরনের ফল মূল বা ড্রাই ফুডস খেতে হবে। এই সমস্ত খাবারে প্রচুর পরিমাণে মিনারেলস ও ক্যালসিয়াম থাকে। যেমন কিসমিস, খেজুর ইত্যাদি। এগুলো সপ্তাহে দুই তিন দিন করে খেতে পারেন।
অনেকে এই সময়ে গরুর মাংস তুলনামূলক কম খেতে সাজেস্ট করে থাকেন। কিন্তু গরুর মাংস হল বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদানের উৎকৃষ্ট উৎস। যা গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের অবশ্যই খাওয়া দরকার তার শিশুর বুদ্ধি বিকাশের জন্য। গরুর মাংস হল আয়রনের উৎস। গরুর মাংসের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে আয়রন, ফলিক এসিড, জিঙ্ক, ম্যাগনেসিয়াম এবং যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স আছে। ভিটামিন বি কমপ্লেক্স বাচ্চার নার্ভ সিস্টেমকে ঠিক রাখে।
তাই প্রত্যেক গর্ভবতী মা প্রতি সপ্তাহের মধ্যে অন্তত দুই দিন তার খাদ্যতালিকায় গরুর মাংস বা খাসির মাংস রাখতে পারেন। তবে সরাসরি মাংস রান্না খেতে না পারলে কাবাব অথবা কিমা করে টেস্টি বানিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করুন।
প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় বিভিন্ন ধরনের সুপ খাওয়ার চেষ্টা করবেন। যেমন মিষ্টিকুমড়ার সুপ। এটা বাচ্চার ব্রেইনের জন্য খুবই উপকারী। বিকালে অবসর সময়টায় নাস্তার সাথে সুপ খাওয়ার চেষ্টা করুন।
আমরা প্রতিদিন যেই চাউল খাই বা রুটি খাই সেটা যদি ঢেঁকিছাটা চাল ও গমের আটা দিয়ে রুটি তৈরি করে খেতে পারেন তাহলে থায়ামিন এবং রিবোফ্লাবিন যথেষ্ট পরিমাণে পাবেন। রিবোফ্লাবিন বাচ্চার ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূলত ভিটামিন বি কমপ্লেক্সটাই বাচ্চার ব্রেইন ডেভেলপমেন্টে অনেকখানি কাজ করে থাকে।
সন্তান মেধাবী ও বুদ্ধিমান হতে হলে গর্ভবতী মায়ের খাদ্য তালিকায় কপার ও জিংক সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা জরুরী। যেমন কাজুবাদাম, অ্যাভোকেডো, মটরশুঁটি, বিনস, বিটে প্রচুর কপার থাকে। আর জিঙ্কসমৃদ্ধ খাবারগুলো হল শস্যজাতীয় খাবার, ছোলা, গরুর মাংস ইত্যাদি। এগুলো খাবারের মধ্যে পরিমাণমতো রাখতে হবে। একজন প্রসূতি মা এগুলো খেলে গর্ভকালীন শিশুর মস্তিষ্কের কোষের গঠন সঠিকভাবে হতে থাকবে।
এছাড়া গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে ভিটামিন ডি এর অভাব হলেও শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ সঠিকভাবে হয় না। তাই গর্ভবতী মাকে ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার যেমন দুধ, দই, পনির, গরুর মাংস, কলিজা ইত্যাদি খেতে হবে। এই জাতীয় খাবারে প্রচুর ভিটামিন ডি থাকে। পারলে নিয়মিত সূর্যর আলোতে কিছুক্ষণ থেকেও ভিটামিন ডি গ্রহণ করতে পারেন।
এছাড়া আয়রন, ক্যালসিয়াম ও ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড যুক্ত সমস্ত খাবার একজন গর্ভবতী মায়ের খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে সন্তান মেধাবী ও বুদ্ধিমান হওয়ার জন্য। সপ্তাহে দুইদিন সামুদ্রিক মাছ খেতে হবে যাতে ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়। সাথে সেলেনিয়াম ও পাওয়া যাবে যা বাচ্চাদের ডেভেলপমেন্টের জন্য অনেক বেশি সাহায্য করে থাকে।
সন্তান মেধাবী ও বুদ্ধিমান হতে আয়োডিন খুবই জরুরি। তাই আয়োডিন যুক্ত খাবার খাওয়া জরুরী। এ জন্য খাবারের তালিকায় প্রতিদিন আয়োডিনযুক্ত খাবার যেমন সামুদ্রিক মাছ, গলদা চিংড়ি, ডিম, কলিজা, ভুট্টা ইত্যাদি একজন প্রসূতি মাকে খেতে হবে। চিংড়ি মাছে এলারজি থাকলে সেটা খাওয়া এড়িয়ে যেতে পারেন।
আবার আছে সন্তান মেধাবী ও বুদ্ধিমান হওয়ার জন্য মায়ের গুড ফ্যাট গ্রহণ। একজন গর্ভবতী মাকে বাচ্চার ব্রেইন ডেভলপমেন্ট এর জন্য গুড ফ্যাট খাওয়া অত্যন্ত জরুরি। যা আপনি সামুদ্রিক মাছ ও বাদাম থেকে পাবেন। এই গুড ফ্যাট নিয়মিত না খেয়ে মাঝে মাঝে এক থেকে দুই চামুচ ঘি অথবা বাটার খাওয়ার চেষ্টা করবেন।
সন্তান মেধাবী ও বুদ্ধিমান হওয়ার জন্য এতক্ষণ যে সমস্ত খাবার নিয়ে আলোচনা করা হল এগুলোর পাশাপাশি গর্ভবতী মায়ের ওজনের দিকেও অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। যাতে কোনভাবেই অতিরিক্ত ওজন বেড়ে না যায়। তাই প্রত্যেক দিনই এই একই ধরনের খাবারগুলো একত্রে না খেয়ে পুরো সপ্তাহটাকে সবগুলো খাবারকে বিভিন্ন দিনে ভাগ করে তারপর খেতে হবে। তাহলে দেহে ভিটামিনের ব্যালেন্স সঠিক থাকবে। যা পরবর্তীতে সন্তান মেধাবী ও বুদ্ধিমান হওয়ার জন্য হতে সাহায্য করবে।