ব্লাড ক্যান্সার কত প্রকার ও কি কি। ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো কি কি। কীভাবে ব্লাড ক্যানসার নির্ণয় ও প্রতিরোধ করা যায়। ব্লাড ক্যান্সারের সঠিক প্রকারভেদগুলো আমরা অনেকেই জানিনা। আসলে এই ব্লাড ক্যান্সারের বিষয়ে আমাদের প্রত্যেকেরই জানা এবং সচেতন থাকা দরকার। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি বছর এক মিলিয়নের উপরে মানুষ এই ব্লাড কেন্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
ব্লাড ক্যান্সার আসলে অনেক রকমের হয়। ব্লাড ক্যান্সার নির্দিষ্ট করে কোন একটি মাত্র রোগ নয়। ব্লাড ক্যান্সার এর তিনটি প্রধান ধরন রয়েছে। যেমন- লিউকেমিয়া, লিম্ফোমা এবং মাইলোমা। রোগটির নামই হয়েছে এর থেকে। লিউক অর্থাৎ সাদা, আর হিমো অর্থাৎ রক্ত।
এছাড়া ব্লাড ক্যান্সার কত প্রকার সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে বলা যায় ব্লাড ক্যান্সারকে মূলত দুই ভাগেও ভাগ করা যায়। একটা হচ্ছে একিউট ব্লাড ক্যান্সার। যেটা খুব এগ্রেসিভ টাইপের হয় এবং দ্রুত ট্রিটমেন্ট না করলে 100% ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুও হতে পারে।
আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ক্রনিক ব্লাড ক্যান্সার। ক্রনিক ব্লাড ক্যান্সার হলে ডাক্তার অনেকটা সময় পান চিকিৎসা করতে। কারণ রোগটা আস্তে আস্তে বাড়ে ও চিকিৎসা করার সময় থাকে। নিচে বিভিন্ন আলোচনার মাধ্যমে ব্লাড ক্যান্সার কত প্রকার ও কি কি সেসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচিত হল।
শিশুদের ক্ষেত্রে কোন ধরনের ক্যান্সার হয় এবং কেন হয়ঃ
শিশুদের ক্যান্সার বলতে বোঝায় ১৮ বছরের নিচের বয়সীদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়াকে। তবে কিছু কিছু ক্যান্সার রয়েছে যা কেবলমাত্র শিশুদেরই হতে দেখা যায়। যেমন- Neuroblastoma , nephroblastoma, Medulloblastoma , Retinoblastoma, Acute leukemia, Acute lymphoblastic leukemia বা ALL। কিডনি, মস্তিষ্ক ও রক্তের কিছু ক্যান্সার শিশুদের বেশি হয়।
ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই লিউকেমিয়া বা রক্তের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এ ছাড়া আরো যে ধরণের ক্যান্সার হয় সেগুলো হচ্ছে Lymphomas ও কেন্দ্রীয় স্নায়ু ব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরণের টিউমার। বড়দের মতো শিশুদেরও টিউমার হতে পারে। যেমন- ব্রেন টিউমার, কিডনি টিউমার, নিউরো ব্লাস্টোমা ও লিভারের টিউমার ইত্যাদি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে অন্তত তিন লাখ শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। এদের মধ্যে ৭০-৮০% শিশুকেই চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। তবে চিকিৎসা না পেয়ে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে শতকরা ৯০ ভাগ ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশু মারা যেয়ে থাকে।
আরও পড়ুনঃ ব্লাড প্রেসার লো হবার কারণ।
শিশুদের শরীরে ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে এবং চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে কিন্তু বিশেষ এক ধরনের ব্লাড ক্যান্সার বেশি হয় যেটা হচ্ছে Acute lymphoblastic leukemia বা ALL। ব্লাড ক্যান্সারের ক্ষেত্রে শতকরা 80 শতাংশ এই ALL কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে হয়।
আবার অ্যাকিউট মাইলয়েড লিউকেমিয়া (এএমএল) নামে ব্লাড ক্যান্সার আছে। এটি একটি আক্রমণাত্মক ব্লাড ক্যান্সার যা রক্ত এবং অস্থি মজ্জাকে প্রভাবিত করে। এটা সাধারণত বয়স্ক লোকজন তাদের ক্ষেত্রে হয় এবং শিশুদের ক্ষেত্রে ব্লাড ক্যান্সার হয় কিন্তু একটি বিশেষ ধরনের ব্লাড ক্যান্সারই বেশি হয়।
কোন কোন বয়সে তাহলে কি কি ধরনের ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকেঃ
একিউট লিউকেমিয়া, একিউট লিম্ফব্লাস্টিক লিউকেমিয়া বা ALL বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বেশি হয়। সাধারণত 10 বছরের নিচে বাচ্চাদের বেশি হয় এটি। এবার অ্যাকিউট মাইলয়েড লিউকেমিয়া (এএমএল) নামে একটি ব্লাড ক্যান্সার রোগ আছে। যেটা বয়স্ক বেক্তিদের ক্ষেত্রে বেশী হয়। আরেকটি ব্লাড ক্যান্সার Chronic myelogenous leukemia বা CML বা chronic granulocytic leukemia যা যে কোনো বয়সেই হতে পারে। তবে সাধারণত মধ্য বয়সেই বেশি হয়।
আবার Chronic lymphocytic leukemia বা CLL. It is a cancer of the blood and bone marrow. সেইটা কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বয়স্ক লোকজনদের ক্ষেত্রে হয়। এখানে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে, ব্লাড ক্যান্সার যেগুলো আলোচনা হল অনেক রকমের। সবগুলোই কিন্তু ব্লাড ক্যান্সারের অন্তর্গত। আর লিউকেমিয়া হল তাদের মধ্যে একটা ভাগ।
এছাড়া অন্যান্য যে ব্লাড ক্যান্সার গুলো রয়েছে তারা হচ্ছে Multiple myeloma, Lymphoma , Myelodysplastic syndromes (MDS), myeloid neoplasm ইত্যাদি এরকম অনেক নামেড় ব্লাড ক্যান্সার রয়েছে। সাধারণ অর্থে ব্লাড ক্যানসার বলতে লিউকেমিয়া বুঝি। কিন্তু এই অন্যান্যগুলো যেমন- লিম্ফোমা, মাইলমা এগুলোও কিন্তু ব্লাড ক্যান্সারের অন্তর্গত।
মাইলমা যেমন বয়স্ক লোকদের ক্ষেত্রে হয়। লিম্ফোমারও বিভিন্ন রকমের ভাগ আছে। তাদের কিছু কিছু বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কমন এবং কিছু কিছু বয়স্ক লোকদের ক্ষেত্রে হয়।
কীভাবে এই রোগগুলোকে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে?
এতক্ষণ আমরা ব্লাড ক্যান্সার কত প্রকার সেগুলো জানলাম। এখন জানব কীভাবে এই রোগগুলো নির্ণয় করা হয়। ব্লাড ক্যান্সার নিয়ে যখন কথা হচ্ছে তখন প্রথমত রুগী এসে প্রেজেন্ট করবে ক্যান্সারের কিছু সিমটম নিয়ে যেগুলো এতক্ষণ আলোচনা হয়েছে। যখনই এই সিমটমগুলো রুগীর শরীরে লক্ষ্য করা যাবে তখন প্রাথমিক ভাবে আমাদের সন্দেহ করতে হবে যে এটি কোন ধরনের ব্লাড ক্যান্সার নয় তো?
সেক্ষেত্রে প্রথমেই যে পরীক্ষাটি করতে হয় সেটি হচ্ছে রক্তের পরীক্ষা বা complete blood count. সেটা থেকে আমরা আভাস পেতে পারি যে রুগীর ব্লাড ক্যান্সারের সম্ভাবনা হয়তো আছে। তারপর এই রোগটিকে ডায়াগনোসিস করতে গেলে বা কনফার্ম করতে গেলে কিন্তু বোন ম্যারো বা অস্থিমজ্জা পরীক্ষা করতে হবে।
আরও পড়ুনঃ উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ ও কারণগুলো কি কি?
কারণ আমাদের রক্ত তৈরি হয় হাড়ের ভেতরকার যেই মজ্জা রয়েছে সেই মজ্জা থেকে এবং যেহেতু রক্তটা মজ্জা থেকে তৈরি হয় সুতরাং ব্লাড ক্যান্সার ডায়াগনসিস কনফার্ম করতে গেলে আমাদের মজ্জা পরীক্ষা করতে হবে।
মজ্জা পরীক্ষা থেকে চিকিৎসক তিনটি পরীক্ষা করেন। সেগুলো হল, একটা পরীক্ষা করে দেখা হয় রুগীটির ব্লাড ক্যান্সার আছে কিনা? দ্বিতীয় পরীক্ষাটি করা হয় যদি ব্লাড ক্যান্সার হয়ে থাকে তাহলে কি ধরনের ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে ? কারণ বিভিন্ন রকমের ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়ে থাকে।
তিন নম্বর হচ্ছে আরও কিছু টেস্ট করা হয় মানে কিছু মার্কার সিমটম দেখা হয় যেটা দেখে আভাস নেয়ার চেষ্টা করা হয় যে এই ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা করলে রুগীর ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কতটা। এই কম্প্লিট পরীক্ষাটা বোন ম্যারো থেকে করার পরেই ব্লাড ক্যান্সারের রুগীকে ডায়াগনসিস করা হয়।
কিছু কিছু ব্লাড ক্যান্সার রয়েছে যেমন ধরুন লিম্ফোমা। সেগুলো কিন্তু বোন ম্যারোর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন লিঙ্ক নোট বা গ্ল্যান্ড সেগুলোকে ইফেক্ট করে। সেক্ষেত্রে আমাদের লিঙ্ক নোটের বায়োপসি করতে হবে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে, বায়োপসি কি ? বায়োপসি মানে হল, কোন রুগীর ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা দেখা দিলে বা সন্দেহ হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এই প্রক্রিয়া চলাকালীন কোষের একটি ছোট নমুনা সংগ্রহ করেন। পরে এই কোষগুলোর মধ্যে ক্যান্সারের উপস্থিতি রয়েছে কিনা সেটা গবেষণা বা পরীক্ষা করার জন্য সাইন্স ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়। একেই বায়োপসি বলা হয়।
তারপর আরেকটি পরীক্ষা করে দেখা হয় সেটা হল যে, ব্লাড ক্যান্সার ডায়াগনোসিস করার পরে রুগীর দেহে ক্যান্সারের জীবাণুটা ঠিক কতটা জায়গায় ছড়িয়েছে। সাধারনত এটা দেখার জন্য অনেক সময় রুগীর সারা শরীরের সিটিস্ক্যান করতে হয়।
ব্লাড ক্যান্সার এর কি কি চিকিৎসা ও প্রকারভেদ রয়েছেঃ
বিভিন্ন রকমের ব্লাড ক্যান্সার এর চিকিৎসা বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। সাধারণ অর্থে ব্লাড ক্যান্সার এর ট্রিটমেন্ট করা হয় কেমু থেরাপি দিয়ে। কোন কোন ক্ষেত্রে রেডিও থেরাপিও লাগে। যে সমস্ত ব্লাড ক্যান্সার গুলো খুব বেশী ভয়ানক। যেমন- মালটি একিউট লিউকেমিয়া, একিউট লিম্ফব্লাস্টিক লিউকেমিয়া বা ALL, অ্যাকিউট মাইলয়েড লিউকেমিয়া (এএমএল) এগুলো হচ্ছে মালটি এজেন্ট কেমু থেরাপি।
অর্থাৎ একাধিক কেমু থেরাপি ক্যান্সারের ধরণ বুঝে বিভিন্ন সময় ও শিডিউল অনুযায়ী বিভিন্ন সিকুন্সে দেয়া হয়। কোনটা প্রত্যেকদিন, আবার কোনটি সপ্তাহে একবার ইত্যাদি এরকম বিভিন্ন শিডিউল অনুযায়ী দেয়া হয়। আবার বিভিন্ন রকমের ব্লাড ক্যান্সারের ট্রিটমেন্টের ডেকুরেশানও কিন্তু আলাদা হয়ে থাকে।
যেমন একিউট লিম্ফব্লাস্টিক লিউকেমিয়া বা ALL এর ট্রিটমেন্ট একটু লম্বা সময় ধরে করতে হয়। প্রায় দুই বছর ধরে সময় নিয়ে এর চিকিৎসা করতে হয়। তার মধ্যে প্রথম ৪ থেকে ৬ মাস ইণ্টেন্সিভ ট্রিটমেন্ট। তারপর থেকে শুধু মেইনটেনেন্স করতে হয় যা ঘরে বসে একটি বা দুটি ঔষধ দিয়ে যেতে হয়। অ্যাকিউট মাইলয়েড লিউকেমিয়া (এএমএল) এর ট্রিটমেন্ট করতে গেলে ৪ থেকে ৬ মাস সময় লাগে।
আবার কিছু কিছু ব্লাড ক্যান্সার আছে যেমন Chronic myelogenous leukemia বা CML, Chronic lymphocytic leukemia বা CLL এগুলকে সাধারনত টারগেটেড থেরাপি দেয়া হয়। এর মানে হল ক্যানসার কেন হয়েছে সেই জেনেটিক্স বা জিনগত কারণটি জেনে সেইখানে একটি বা দুটি ঔষধ দেয়া হয়।
আবার অনেক ক্ষেত্রে কোন কোন বিশেষ ধরনের ব্লাড কেন্সারকে শুধু মাত্র মুখে খাওয়ার ঔষধ দিয়েও কিন্তু ব্লাড ক্যানসার সারিয়ে তুলা যায়। যেমন CML, CLL ইত্যাদি। এগুলকে শুধু মাত্র মুখে খাওয়ার ঔষধ দিয়ে ও টারগেটেড থেরাপি দিয়ে সম্পূর্ণরূপে সারিয়ে ফেলা যায়।
ব্লাড ক্যানসারকে আমরা নিজেরা কীভাবে প্রতিরোধ করতে পারবঃ
যে কোন ধরনের ক্যানসার প্রতিরধের জন্য আমাদের যেই রকমের হেলদি লাইফ স্টাইল দরকার ব্লাড ক্যানসারের ক্ষেত্রেও কিন্তু সেটাই করা উচিত। কিন্তু ব্লাড ক্যানসারেরই কোন নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্য আমরা বলতে পারি আপনি ধূমপান বন্ধ করে দিন তাহলে আপনার ফুসফুসের ক্যান্সার কম হবে বা কিছু কিছু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে আমরা বলা হয় যে আপনার pollution expose না হলে ক্যানসার কম হবে।
আবার গ্যাষ্টীকের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে আমরা বলি যে ফ্রাইড ফুড বা প্রিজারভ জাতীয় ফুড না খেলে ক্যান্সারের আশঙ্কা কম হবে। ব্লাড ক্যানসারের ক্ষেত্রে কিন্তু এই রকমের রিলেশান বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে জীবন যাপন করা, কেমিক্যাল বিহীন ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকা, pollution expose এড়িয়ে চলা, নিয়মিত এক্সারসাইজ ও সময়মত ঘুম ও জাগা এগুলো ঠিকমত করতে পারলে ব্লাড ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ব্লাড ক্যানসার কে সম্পূর্ণ রূপে নির্মূল করা সম্ভব কি না?
কেন্সার রোগটি এমনিতেই ভয়ের একটি কারণ। অনেকের কাছে এটা মরন ব্যাধি নামে পরিচিত। তারউপর যদি শুনা যায় যে ব্লাড ক্যানসার হয়েছে। তখন আরও অনেক বেশী ভয়ংকর লাগে। আমাদের মধ্যে একটি ভয় বা ধারনা সবসময় থাকে যে ক্যানসার হলেই তাকে আর বাঁচানো যাবে না। এর কোন চিকিৎসা নেই বা মানে নিশ্চিত মৃত্যু। অথবা অনেক টাকা খরচ করে কিছুদিন চিকিৎসা করে কিছুদিন হয়তো বাঁচিয়ে রাখা যায় কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ করে তুলা যায় না।
একটি বিষয় পরিস্কার করে জানতে হবে যে, ক্যানসার শুধু একটি মাত্র কোন রোগ নয়। ক্যানসার হচ্ছে একাধিক রোগের সমষ্টি। বিভিন্ন রকম ক্যান্সারের ধরন কিন্তু আলাদা হয়ে থাকে। তারা প্রত্যেকটি একেকটি আলাদা আলাদা রোগ। অনেক ক্যান্সারকে সারিয়ে ফেলা যায়। এর মধ্যে যে সমস্ত ক্যানসারগুলোকে পুরোপুরি সারিয়ে তুলা যায় তার মধ্যে ব্লাড ক্যানসার অন্যতম।
অন্যান্য ক্যান্সারের তুলনায় ব্লাড ক্যান্সারের বৈশিষ্ট্য হল এটা খুব এগ্রেসিভ হয়। মানে এটা খুব অল্প সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। দ্রুত চিকিৎসা না করালে প্রায় দুই একটি ব্লাড ক্যানসার বাদে বেশীর ভাগ ব্লাড ক্যান্সারের রুগীই মারা যায়।
প্রত্যেকটি ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য আন্তর্জাতিক ভাবেই নির্দিষ্ট গাইডলাইন দিয়ে চিকিৎসা রয়েছে। সেই নিয়ম মেনে একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থেকে যদি সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ধাপে ধাপে অর্থাৎ যেভাবে গাইডলাইন দেয়া আছে, যদি সেভাবে চিকিৎসা করা যায় তাহলে ব্লাড ক্যান্সারকে সম্পূর্ণরূপে সারিয়ে ফেলা যায়।
যেমন চিকিৎসকদের মতে একিউট লিম্ফব্লাস্টিক লিউকেমিয়া বা ALL এর মত এগ্রেসিভ টাইপের ব্লাড ক্যান্সারের ট্রিটমেন্ট বিশেষ করে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে শতকরা ৮০ ভাগ রুগী সারিয়ে ফেলা সম্ভব। Hodgkin lymphoma (HL) নামে এক ধরনের ক্যানসার রয়েছে। সেটাকেও প্রায় ৮০ শতাংশের উপরে সারিয়ে ফেলা সম্ভব।
বিশেষ এক ধরনের ক্যানসার যেমন Chronic myelogenous leukemia বা CML এর যদি সঠিক নিয়মে চিকিৎসা করা হয় তাহলে প্রায় ৭০ শতাংশের উপরে ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ব্লাড ক্যান্সারের আরেকটি উন্নত চিকিৎসা রয়েছে সেটা হল bone marrow transplantation বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন। ব্লাড ক্যান্সারের উৎসই হল কিন্তু Stem cells। Stem cell এ সমস্যা রয়েছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে যুগান্তর এনেছে এই স্টেল সেল থেরাপি। এই স্টেম সেল হলো মানব শরীরের আদি কোষ। আমরা জন্মানোর পর এই একটি কোষ থেকেই সব ধরনের কোষ তৈরি হয়। ব্লাড ক্যান্সারে বোন ম্যারো ট্রন্সপ্লান্টেশন বা স্টেম সেল থেরাপি জুগান্তরকারি ও সফলতম প্রয়োগ বলা যায়।
যদি কোন একজন সু-স্বাস্থ্যবান মানুষের Stem cells বিশেষ করে ভাই অথবা বোন যাদের ক্ষেত্রে জন্মগত ভাবেই জেনেটিক ম্যাচিং থাকে। যদি ১০০% ম্যাচিং থাকে তাহলে চিকিৎসাটি ভাল হয়। আবার এই Stem cell এক না হলে বা ম্যাচ না হলেও কিন্তু বডি এটা নিবে না। তাই জেনেটিক ম্যাচ করা একটি সুস্থ Stem cell নিয়ে যদি ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা করা হয় তাহলে তাকে বলে bone marrow transplant।
তার মাধ্যমে বেশীর ভাগ ব্লাড ক্যানসার কে সম্পূর্ণ রূপে সারিএ ফেলা যায়। প্রথমত যেটা প্রয়োজন সেটা হল ব্লাড ক্যান্সারের সিমটম দেখা গেলে একজন হেমাটোলজিষ্ট এর কাছে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে তার এই সিমটমগুলো ব্লাড ক্যান্সারের জন্য হচ্ছে কি না। আর দ্বিতীয়ত দেখতে হবে যে তার এই কেন্সারটি কি ধরনের ক্যানসার। তারপর সে ধরণ বুঝে সঠিক নিয়মে তার চিকিৎসা করাতে হবে। তাহলে বেশীরভাগ ব্লাড কেন্সারকে সম্পূর্ণ রূপে সারিএ ফেলা যাবে।
একইভাবে মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের ক্ষেত্রে হৃৎপিন্ডের মৃত কোষ বা সিরোসিস অফ লিভার সরানো সম্ভব এই বোন ম্যারো ট্রন্সপ্লান্টেশন বা স্টেম সেল থেরাপির মাধ্যমে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন কি? সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন অনুসারে, হৃদপিণ্ডের পেশির একটি অংশ অনেক সময় যথেষ্ট পরিমানে রক্ত পায় না। তখন হৃদপিণ্ডের পেশীতে রক্তপ্রবাহ পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে যত দেরী হয় ততই হৃদপিণ্ডের পেশী ততই ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে। এই অবস্থাকে মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বলা হয়।
এতক্ষণ আমরা ব্লাড ক্যান্সার কত প্রকার হতে পারে সেটা সম্পর্কে জানলাম। পরিশেষে বলা যায় যে, ব্লাড ক্যানসার হলে ভয়ের কোন কারণ নেই। উন্নত চিকিৎসার বদৌলতে এখন ব্লাড কেন্সারকে সম্পূর্ণরূপে সারিয়ে ফেলা যায়। এমনকি ক্যান্সার নিয়েও মানুষ বহুদিন বেঁচে থাকতে পারে। বিভিন্ন রকমের ব্লাড ক্যান্সার বিভিন্ন সময় হয় এবং সকল প্রকার ব্লাড ক্যান্সারের জন্য আলাদা চিকিৎসা পদ্ধতিরও প্রয়োজন হয়।
অনেকে ব্লাড ক্যানসারকে একটি ব্যয় বহুল চিকিৎসা মনে করেন। তবে ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসায় অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতাই বড় বিষয় নয় বরং সঠিক সময়ে ক্যানসার চিহ্নিত করে তার সঠিক চিকিৎসা নিতে না পারাটাই হলো অন্যতম সমস্যা।