উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ ও কারণ। উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে জানার আগে আমাদেরকে জানতে হবে রক্তচাপ কি। আমাদের শরীরে হৃদপিণ্ড পাম্প করে সারা শরীর রক্ত সঞ্চালন করে আবার পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এভাবে পাম্প করে প্রতি মিনিটে হার্ট ৬০ থেকে ৭০ বার রক্ত Contraction করে অর্থাৎ সঙ্কোচন ও প্রসারনের মাধ্যমে রক্তকে ধমনীর মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে দেয়। রক্ত যখন ধমনীর মধ্য দিয়ে এভাবে প্রবাহিত হতে থাকে তখন ধমনীর গায়ে একটা পার্শ্ব চাপ তৈরি হয়। এটাই হল Blood Pressure বা রক্তচাপ।
এই রক্তচাপ আবার দুই ধরনের। যেমন- উচ্চ রক্তচাপ ও নিম্ন রক্তচাপ। হার্ট রক্ত পাম্প করার ফলে রক্তনালীতে স্বাভাবিক যে চাপ থাকে সেটাকে বলা হয় সিস্টোলিক রক্তচাপ। আর হার্ট যখন রিলেক্স করে তখন তাকে ডাইস্টোলিক ব্লাড প্রেসার বলা হয়। তাই উচ্চ রক্তচাপ হবার আগেই আমাদেরকে উচ্চ রক্তচাপের নরমাল সংজ্ঞাটি সম্পর্কে ভালকরে জানতে হবে। তাহলে কত হলে আমরা নরমাল ব্লাড প্রেসার আছে বলতে পারি? ব্লাড প্রেসার মাপার পরে কারও রিডিং যদি ১২০/৮০ (১০ প্লাস অথবা মাইনাস হতে পারে) মিলিমিটার মার্কারি হয় তাহলে নরমাল ব্লাড প্রেসার হিসেবে ধরা হয়।
এই নরমাল হতে সংখ্যা যদি উপরে থাকে যেমন- ১৪০/৯০ মিলিমিটার মার্কারি বা এর চাইতেও বেশী হয় তাহলে ধরে নেয়া যায় তার যে উচ্চ রক্তচাপ আছে। অপরদিকে রক্তচাপ যদি ৯০/৬০ মিলিমিটার মার্কারি বা তার আশেপাশে থাকে তাহলে সেই বেক্তির লো ব্লাড প্রেসার আছে। যদিও বয়স ভেদে এর রিডিং কম বেশী হতে পারে। তবে শুধু মাত্র একবার মেপেই যদি প্রেসার বেশি দেখা যায় তাহলে আরো কয়েকবার প্রেসার মাপতে হবে। এরপর যদি Persistently প্রেসার রেগুলার বেশি দেখায় তাহলে বুঝতে হবে যে রুগীর উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে।
কি কারণে উচ্চ রক্তচাপ হয় বা এর কারণ গুলো কি কি?
মানব শরীরে হার্টের ধমনীতে রক্ত প্রবাহের চাপ যখন অনেক বেশী থাকে তখন সেটা high blood pressure বা উচ্চ রক্তচাপ হিসাবে ধরা হয়। আর সময়মত এই high blood pressure বা উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা না করলে বা রক্তচাপ বেশি হওয়ার জন্য বা নিয়ন্ত্রণে না রাখার কারনে যে কোনো মুহূর্তে মানুষ মৃত্যুর মুখে পতিত হতে পারে। তাই উচ্চ রক্তচাপকে হালকা ভাবে নেয়া যাবে না। সাধারনত ৪০ বছর বয়সের পর থেকে উচ্চ রক্তচাপের আশঙ্কা বাড়তে থাকে। তাই উচ্চ রক্তচাপের উপসর্গগুলো জানার আগে কি কারণে উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকে সেই কারনগুলো আমাদেরকে আগে জানতে হবে।
মানব শরীরে হার্ট এই যে পাম্প করে তার দুইটা কারণ থাকে। একটি প্রাইমারি, যেটা আমরা জানিনা। আরেকটি হলো সেকেন্ডারি, এর কারণগুলো আমরা জানি। যেমন- থাইরয়েডের গ্ল্যান্ডের অসুখ, কিডনির অসুখ ইত্যাদি। এগুলোর অসুখের কারণে উচ্চ রক্তচাপ বাড়ে। তাই এগুলোর চিকিৎসা করলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আরেকটি হল প্রাইমারি বা এসেন্সিয়াল হাইপার টেনশান। এগুলো সম্পর্কে খুব বেশি জানা সম্ভব হয়নি। তবে কিছু নিয়ম কানুন বলা আছে। সেগুলো মেনে চললে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। যেমন অনেকে খাবারের সাথে বা আলাদা করে লবণ বেশি খায়। আবার অনেকে মোটা তাদের কিন্তু উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।
আরও পড়ুনঃ কীভাবে ঘরে বসে খুব সহজে নিজের ব্লাড প্রেসার মাপবেন?
আবার অনেকে অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত বা জীবন যাপন করেন। অনেকে ধূমপান বা মদপান করেন অথবা ক্যাফেইন জাতীয় খাদ্য বা কোমল পানীয় পানে অভ্যস্ত। আবার শারীরিক বা মানুসিক চাপ থাকলে তাদের কিন্তু উচ্চ রক্তচাপ হবার সম্ভাবনা থাকে। তবে আবার এমন আছে যে শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ রোগী জানেনই না যে তার উচ্চ রক্তচাপ হয়েছে বা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। কারন, এদের কোন উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ ও উপসর্গ পাওয়া যায় না।
এভাবে একজন রুগী উপসর্গগুলি না জানার কারণে ও দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপে ভুগতে থাকার দরুন শেষ পর্যায়ে গিয়ে যখন তার নির্দিষ্ট কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো সমস্যা সৃষ্টি করে উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ গুলো প্রকাশ পায়। তখন জানতে পারা যায় যে তার উচ্চ রক্তচাপ হয়েছে।
এগুলো খুবই ভয়ানক রোগ। কারণ হঠাৎ করে এগুলো দেখা দেয়। দেখা গেল যে আপনি সুস্থই আছেন সবকিছুই স্বাভাবিকভাবেই চলছে। দেখা গেল হঠাৎ করে আপনার স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল। এটাই হল সাইলেন্ট হাইপার টেনশনের কাজ। হঠাৎ করেই হবে। এক্ষেত্রে ডাক্তার ও রোগী উভয়েরই চিন্তায় পড়ে যান যে হঠাৎ করে উপসর্গ নিয়ে আসলো। তাই উচ্চ রক্তচাপ হলো একটি ভয়ঙ্কর রোগ।
উচ্চ রক্তচাপকে সাইলেন্ট কিলার বা সাইলেন্ট হাইপারটেনশনও বলা হয়। প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য এটা অত্যন্ত ভয়ংকর একটি রোগ। এরকম হলে হঠাৎ করে উচ্চ রক্তচাপ শরীরের জটিলতা সৃষ্টি করে বা ঘটায়। যেমন- স্ট্রোক, হার্ট এটাক, চোখে সমস্যা দেখা দেয়া এবং সকল প্রকার কিডনি রোগই উচ্চ রক্তচাপের কারণে হয় অর্থাৎ Any chronic disease of kidney. আবার দীর্ঘদিন যদি কেউ কোন ড্রাগস সেবন করেন সে ক্ষেত্রেও উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।
যেমন কেউ যদি দীর্ঘদিন স্টেরয়েড খায়, ওরাল কনটিসেপটিক পিল খায়, দীর্ঘদিন যদি নাকের ড্রপ ব্যবহার করা হয়, এনেসিড ঔষধ যদি কেউ দীর্ঘদিন ধরে খায় তখন হাইপারটেনশন হতে পারে। এছাড়া কোনো কারণে প্রেসারে থাকলে বা ব্রেনের টিউমার হলে উচ্চ রক্তচাপ হবে। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে অ্যালকোহল সেবনে বা মাত্রাতিরিক্ত সেবনের ফলে উচ্চ রক্তচাপ হয়। এমনকি ঠিকমত ঘুম না হওয়াও উচ্চ রক্তচাপের একটি অন্যতম কারন।
উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ ও উপসর্গগুলো কি কি?
উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ গুলো মানব দেহে সেভাবে প্রকাশ পায়না। তারপরও একজন রোগী কিভাবে বুঝতে পারবেন যে তার উচ্চ রক্তচাপ আছে। যেমন- ঘাড়ে ব্যথা করা, প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরানো, মাথা ঝিমঝিম করা, বমি ভাব আসা কিংবা অনেক সময় রুগী বমি করেও দেন, বুকে ব্যাথা অনুভব করতে থাকা, অল্পতেই রেগে যাওয়া বা খিটখিটে মেজাজ হওয়া, দেহের মধ্যে অস্থির ভাব থাকা, রাতে ভাল ঘুম না হওয়া, জ্ঞান হারিয়ে ফেলা ইত্যাদি এগুলো উচ্চ রক্তচাপের প্রাথমিক লক্ষণ। এসব উপসর্গ দেখা দিলেই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে ও চিকিৎসা নিতে হবে।
আবার ৯৫ পার্সেন্ট হল এসেন্সিয়াল হাইপারটেনশন। এসেন্সিয়াল হাইপারটেনশন মানে হল একটি নির্দিষ্ট কোন কারণে নয়। মাল্টিপল কারন থাকতে পারে। যেমন বংশানুক্রমিক বা পরিবারের সদস্য যেমন- পিতা, মাতা, ভাই, বোন এদের উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা থাকা। ৫ থেকের ৬ পার্সেন্ট রোগীর উচ্চ রক্তচাপের কারণ জানা যায়। কারন জানা যাওয়ার ফলে যদি ঠিকমত চিকিৎসা করানো হয় তাহলে উচ্চ রক্তচাপ হতে সুস্থ করে তোলা যায়। ৩০ বছরের নিচে মানুষের সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন হিয়।
রক্তচাপ মাপতে গিয়ে যদি (সিষ্টোলিক) ১৩০ থেকে ১৩৯ বাই ৮১ থেকে ৮৯ (ডায়াষ্টোলিক) মিলিমিটার মার্কারি হলে প্রি হাইপারটেনশন ধরা হয়। তখন তাদেরকে লাইফ স্টাইল পরিবর্তন এর জন্য পরামর্শ দেয়া হয়। তারপর হল স্টেজ ওয়ান। এই স্টেজে ব্লাড প্রেসার থাকবে ১৪০ থেকে ১৫৯ বাই ৯০ থেকে ৯৯ মিলিমিটার মার্কারি। এরপর আরও বাড়লে স্টেজ দুই। একজন রোগীর প্রেসার মাপার পর যদি দেখা যায় তার ব্লাড প্রেসার ১৮০ বাই ১২০ উঠেছে তাহলে বুঝতে হবে তার উচ্চ রক্তচাপ হয়ে গেছে এবং জরুরি ভিত্তিতে তার চিকিৎসা দরকার।
উচ্চ রক্তচাপ হবার আগেই আমাদের করণীয় কি?
আমাদের প্রথম করনীয় হলো রক্তচাপ নিয়মিত মাপতে হবে এবং দ্বিতীয়ত আপনার লাইফ ষ্টাইল পরিবর্তন করতে হবে। নিজের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন। ফলমূল ও শাক সবজী বেশী করে খেতে হবে বিশেষ করে আঁশ জাতীয় খাবার। আপনি মনে হবে সুস্থই আছেন তবুও রক্তচাপ নিয়মিত মাপতে হবে অন্তত সাইলেন্ট হাইপার টেনশন হতে বাঁচার জন্য। তাই মাসে ১ থেকে ২ বার রক্তচাপ মাপুন অথবা বছরে একবার ফুল বডি চেকআপ করুন।
তাহলে ডাক্তার আপনার সাইলেন্ট ব্লাড প্রেসার হয়ে থাকলে চিহ্নিত করার সহজ হবে ও আপনি চিকিৎসা নিতে সুযোগ পাবেন। এছারা আপনার বয়স যদি ৪০ বছর অতিক্রম করে থাকে তাহলে তিন থেকে ছয় মাস অন্তর নিয়মিত ব্লাড প্রেসার মাপুন। উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ ও কারণ সম্পর্কে আশাকরি কিছুটা ধারনা পেয়েছেন।